প্রকাশিত: Wed, Dec 21, 2022 4:14 AM
আপডেট: Wed, Jul 2, 2025 3:03 AM

বিশ্বকাপ ফুটবল কেবল আনন্দ নয়, জানা বোঝার অনেক নতুন উপাদানও দিয়ে গেলো

আলতাফ পারভেজ

[২] বিশ্বকাপ ফুটবল কেবল আনন্দ নয়, জানা-বোঝার জন্য অনেক নতুন উপাদানও দিয়ে গেলো বোধহয় আমাদের। খেলোয়াড়দের সংমিশ্রণ ছিল এবার খেয়াল করার মতো। ৩২ দলের মাঝে ১৩৬ জন খেলোয়াড় ছিলেন, যাদের জন্ম এক দেশেÑখেলেছেন আরেক দেশের হয়ে। ১৬ শতাংশ খেলোয়াড় ছিলেন এরকম। এদের বড় এক অংশ ‘কালো’। তবে একে কেবল আফ্রিকার উত্থান আকারে দেখারও সুযোগ নেই। আফ্রিকার টিমগুলোতে যারা খেলেছেন তাদের অনেকের বড় হওয়া আফ্রিকার বাইরে। ‘দেশ’-এর ধারণা যে দুনিয়ায় পাল্টাচ্ছে, সেটাও দেখাচ্ছে ফুটবলাররা। 

সুইস ব্রিল এম্বোলোর কাহিনি ইতোমধ্যে সবাই জানে। বিশ্বকাপে প্রথম গোল তাঁর জন্মভূমি ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে। বাবা এখনো সেখানেই থাকেন। কিন্তু তাঁর পাসপোর্ট সুইস। খেলাটা তাঁর কাছে শৈল্পিক উৎকর্ষতা ও অর্থনৈতিক বিষয়-আশয় মাত্র। কিন্তু তাঁর গোলে সুইসরা কম নাচেনি। ইনাকি ও নিকোর ব্যাপার আরও মজার ছিল। উভয়ের জন্ম স্পেনে। বাবা-মা ঘানার। দুজনেই কাতার এসেছেÑতবে দুই দলের হয়ে। ইনাকি লড়লো ঘানার হয়ে—নিকো স্পেনের টিমে। 

ইনাকির ৯০ বছর বয়সী দাদা নাতিকে ঘানার জার্সিতে দেখে বেজায় খুশি। মৃত্যুর আগে এটা নাকি তাঁকে বড় তৃপ্তি দিলো। কিন্তু ইনাকি নিয়মিত নাইকোকে টিপস্ দিয়ে যাচ্ছে কিভাবে স্পেনের জাতীয় দলে আরও ভালো করতে পারে। কাতারের টিমের কথাও আমরা জানি। ৩৮ ভাগ খেলোয়াড় জন্মগতভাবে কাতারি নন। মরোক্কোর বেলায় এই সংখ্যা আরও বড়। অথচ সবাই মরক্কোর বিজয়কে বলছে আরব-আফ্রিকার উত্থান। আমিও শুরুতে তা লিখেছিলাম। তিউনেশিয়ার ৩৮ ভাগ খেলোয়াড়ের জন্ম ফ্রান্সে। এক কাগজে দেখলাম, এবারের বিশ্বকাপে বিভিন্ন দেশের হয়ে খেলতে এসেছেন ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া ৫৯ জন। ‘সাধারণ’দের ‘তারকা’ বানিয়ে দেওয়ার এরকম কৃতৃত্বের জন্য ফ্রান্সের ক্রীড়া কাঠামোকে অভিবাদন জানাতেই হয়। 

আফ্রিকার বহু দেশ এককালে ফ্রান্সের কলোনি ছিলো। সেখানে ফরাসি ভাষার আধিপত্য আছে। সেসব দেশের মানুষ অভিবাসী হিসেবে আসছে ফ্রান্সে এবং এখানে বড় হয়ে আবার খেলতে চলে যাচ্ছে পূর্ব-পুরুষের কোন ঠিকানায়। মোদ্দাকথা, বিশ্বজুড়ে অভিবাসী সমাজ শক্তিশালী হচ্ছে। সমাজ-সংস্কৃতির চেহারা বদলে দিচ্ছে তারা। যেসব দেশ অভিবাসীদের সম্পদ ভাবছে বা সম্পদ বানিয়ে নিতে পারছেÑজোর কদমে এগোচ্ছে তারা। বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটছে সেসব দেশে, নিজেদের বিকশিত করতে।

এসব কথা যখন লিখছি তখন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফুটবল পাগল কিশোরদের কথা মনে পড়ছে। ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে এদের ভেতর থেকেই জন্ম হতো আন্তর্জাতিক ফুটবল তারকার। কিন্তু ওদের কপাল খারাপ। জন্মেছে বার্মায়। আর আশ্রয় নিয়েছে এমন জায়গায় যেখানে শরণার্থীদের এখনও বোঝা মনে করা হয়। টেকনাফজুড়ে রোহিঙ্গারা ফুটবল খেলছে দেখে ঢাকার একটা মিডিয়া উষ্মা প্রকাশ করে রিপোর্ট করেছে, ‘ক্যাম্পের বাইরে এসে ফুটবল খেলছে রোহিঙ্গারা’, ‘ব্যাপক বিশৃঙ্খলা হচ্ছে’। তাই তো। ভয়াবহ অপরাধ। এরকম হওয়া সঙ্গত নয়! 

[৩] এবারের বিশ^কাপ প্রস্তুতি থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত ফিফার আয় ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় অংকটা বোধহয় এরকম: ৭৯৫০০,০০০০০০০ (উনাশি হাজার পাঁচশ কোটি টাকা মাত্র)। আগের চার বছর সময়ের চেয়ে এটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বেশি। এবারের আয়ের ৫৬ ভাগই এসেছে খেলা দেখানোর অধিকার বিক্রি থেকে। অর্থাৎ পরোক্ষে টিভি দর্শকদের সূত্রে। আরও সরাসরি বললে, আনন্দ করছে একজন আর পকেট ভরেছে অন্য জনের। 

বলা বাহুল্য, ফিফার এই আয়ে বাংলাদেশের মানুষের বড় ‘অবদান’ আছে! ফিফা যে বাংলাদেশকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত তার গোড়ার কারণ সেটাই। এত ‘আনন্দিত’ জাতি প্রকৃতই লাভজনক। বিশ্ব পুঁজিতন্ত্রের ভালো এক জীয়নকাঠি ফুটবল, বিশ্বকাপের মতো বড় ইভেন্টগুলো। এসব থেকে আয় হুহু করে বাড়ছে এখন। অনেক কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিবাদী শাসকদেরও এরকম ইভেন্ট বেশ কাজে দেয়। এসময়টা তারা কম জনঅসন্তোষে থাকে। চাল-ডালের অভাবের মাঝেও মানুষ এসব ইভেন্ট নিয়ে মেতে থাকে (বা তাদের মাতানো হয়)। কাতার-বিশ্বকাপের পর মাতামাতির জন্য নতুন কী আসছে? মিডিয়াগুলো নিশ্চিতভাবেই সেটা ভেবে নিয়েছে। কিছু অনুমান করতে পারছেন? টাকার অংকের হিসাবে ভুল হলে নিজ গুণে ক্ষমা করে দিয়েন। গরিব মানুষের এতো বড় অংক ভুল হতে পারে। সিরিয়াসলি বলছি। ফেসবুক থেকে