হাসান মোরশেদ : গহীন হাওরের এক মৎস্যজীবী গ্রামে ছিলো উৎসবের আবহ। নদীর পাড়ের সবুজ ঘাসের গালিচার উপর নির্মিত কুঞ্জে নারীরা পরিবেশন করছিলেন ধামাইল গান। ধামাইল কি গান নাকি নৃত্য? ধামাইলের সুর ও পরিবেশনা সাধারণত আনন্দময় থাকে। আনন্দের ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলাম। বুঝতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। আনন্দের ঢংয়ে যা পরিবেশিত হচ্ছে তা মূলত বিষাদের ব্যালাড। ‘পাঞ্জাবিদের নির্যাতন, শেখ মুজিবের লড়াই, নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া লাশ, শরণার্থী ক্যাম্পের দুঃসহ জীবন…’ এসব উঠে এসেছে গানে। পরিবেশনা শেষ হলে ভিড়ের মধ্যে উৎস তালাশ করি। ‘এই গান এখানে এলো কী করে? কী কারণে রচিত হলো, কে লিখলেন?’ তালাশে পেয়ে যাই শেষে। একজন মধ্যবয়স্ক নারী জানান, এই গ্রামে তিনি বিয়ে হয়ে এসেছেন, সঙ্গে করে এই গান নিয় এসেছেন তাঁর বাপের দেশ থেকে। বাপের দেশও হাওরের আরেক গ্রাম। এখানে এখনো ‘দেশ’ মানে মানুষের কাছে তাঁর গ্রাম। গানটি লিখেছিলেন তাঁর বাবা। পরিবারের বারোজন সদস্য নিহত হওয়ার পর শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। শরণার্থী শিবিরে বসে এই গান বেঁধেছিলেন। কিশোরগঞ্জের যশোদলে দেখা হয়েছিলো ভাট কবি লাল মাহমুদের সঙ্গে। বরইতলা ম্যাসাকার নিয়ে বড় মর্মস্পর্শী এক আখ্যান গেয়ে শুনিয়েছিলেন তিনি। ইহুদিরা হাজার বছর ধরে মার খেতে খেতে সঙ্গোপনে নিজেদের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পাচার করে দিয়ে গেছে সংগীত ও শিল্পের ফর্মে। এতো মার খেয়েও তারা হারিয়ে যায়নি এই কারণে। এই বঙ্গদেশে যারা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত ইত্যাদি করেন তাঁরা কি এসব খুঁজেন, খুঁজে কি পান এসব? রাজধানী আর বিভাগীয় শহরগুলোতে বর্ণিল আয়োজনে শেষ পর্যন্ত অর্জনটা কী হয়। লেখক ও গবেষক